Monday, 4 October 2021

হলুদ ম্যাট্রেস।। 🌻

বিপদ যে আসলে কি তা যারা নতুন সিনথেটিক ম্যাট্রেসে শোয়েনি তারা কখনো বুঝবেনা। অবশ্যই এই ধারণা আমার তখন ছিল যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। তারপরে সে কত দিন পেরিয়ে গেলো। কত বার নাকানি চোবানী খেলাম, কত অলিগলি পথ পেরোলাম, কত সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম নামলাম.. তা আর মনেও নেই। তবে সেই অক্টোবর এর ভোর আজও আমার মনে থাকবে। দিনটা ছিল মহালয়া। আগের দিনের তুমুল বৃষ্টির দুপুরে বাবা দোকান থেকে আমাদের বিছানায় পাতার জন্যে ইয়া বড় একটি হলুদ রঙের ম্যাট্রেস কিনে এনেছিল। তার সেই চোখ ধাঁধানো রঙ দেখে কি যে তাজ্জব বনে গেছিলাম.. মনে মনে বার কতক ডিগবাজি খেয়ে নিয়েছিলাম। যাক তো সেই আনন্দ বেশি খন টেকেনি। রাত নেমে আসতে নতুন ম্যাট্রেসে গা গড়িয়ে শুয়ে পড়লাম আনন্দ মাখা ঘুম দেব বলে। কিন্তু ওই আনন্দ স্বভাবতই একটি ধারণা ছাড়া যে কিছুই না তা সেই ম্যাট্রেসে শুয়ে বুঝেছিলাম। সিনথেটিক হওয়ার দরুন বিছানার চাদর তাতে কিছুতেই থাকলোনা। শেষে তা তুলে দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তাতেও ফল লবডঙ্কা। শুলেই মনে হচ্ছিল এই বুঝি গড়িয়ে গেলাম। ম্যাট্রেসটির খসখসে surface হওয়ায় গোটা গায়ে অস্বস্তির একেবারে ইয়ে আরকি। নাহ! তবে বাবা মা তাতেও ঘুমিয়ে গেছিলো। ঘুমালাম না আমি। ঘুমোলোনা দিদি। মুখ হাড়ি করে সারা রাত না ঘুমোতে পারার দুরুদুরু বিরক্তি পেটের ভেতর চেপে টিভিতে প্রোগ্রাম দেখেছিলাম সেই বার।

যাক তো তারপরে পেরিয়ে গেলো কত বছর। বড় রা মানতে না চাইলেও আমরাও দেখতে দেখতে একটা গোটা যুগ যে কাটিয়ে ফেললাম তা ভেবেও আশ্চর্য্য লাগে। এই মাঝের এত বছরের ওঠা পড়া, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে মোমো নামক খাদ্যটির সমতলে নেমে আসা, বিজ্ঞাপন এর নাম "reels" হয়ে যাওয়া, নোটবুক ছেড়ে নোটপ্যাড ধরা, উনিভার্সিটি কে শুধু মাত্র নিজের দুহাতের মুঠো দিয়ে চেনা, মৃত্যুকে বারবার দেখা, কিছু সত্যি কথা বলতে গিয়েও আত্মসম্মানের কাছে off-side খেয়ে ঘরে বসে চোখের জল ফেলা, একা হয়ে যাওয়া, মুখোশ এর ওপর আরেকটি কৃত্তিম মুখোশ চাপানো.. সব হলো। দায়িত্ব নিয়েই হলো। তবে সেদিন হঠাৎ আবার ম্যাট্রেসটার দিকে চোখ যেতে মনে পড়ে গেলো সেই রাতে ঘুমাতে না পারার দুঃখ। সেই দিনের পর বছরের পর বছর যে না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি, তাতে দুঃখ নেই। তবে সেই রাতে ঘুমোতে না পারার দুঃখ তা যে আসলে কোথায় এসে লেগেছে তা এত বছরেও বুঝিনি। সময় পাল্টেছে। বছর এগিয়েছে অনেক। নিজের জীবনের পথে চলার সময় গড়িয়ে গেছি লক্ষ বার, কিন্তু সেই ম্যাট্রেসটি আমাকে আজ আর গড়িয়ে ফেলেনা। সেই হলুদ ম্যাট্রেসটার ওপর আজ চেপেছে ধুলো, তুলোর তোষক, মন খারাপ, আনন্দ, ভাঙা ঘর, পুরোনো এলবাম, মাংসের ঝোল, আদি ঢাকেশ্বরীর শাড়ির প্যাকেট, ছোটবেলার হারানোর তালগাছের ছবি যেটা মুড়ে যাওয়ায় সোজা করতে সেখানে কোনো একদিন নিজে রেখে নিজেই ভুলে গেছি... এত কিছুর ভার নিয়ে সে নিজেও আজ বড় ক্লান্ত। তার সাথে সেই যে অভিমান পালা চলত আমার, তা যে কবেই বেমালুম ভুলে গেলাম আমরা.. নিজেরাই সে খবর রাখিনি। আবারও একটা পূজো চলে এলো, আবারও সেই বিরক্তি মাখানো মন খারাপ। আবারও রাতে ঘুম না আসা। আবারও হেরে গিয়ে বেলা অব্দি ঘুম দেওয়া। এই সবের মধ্যে হলুদ রঙের এই ম্যাট্রেস টাও বুড়ো হয়ে গেলো। পেনশনের জন্যে হাকাহাকি করলো বলে...। হয়তো আগের মতো আর ফিরে যেতে পারবোনা ঘুম না হওয়ার দুঃখের দিনে, তবে গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়িতে থাকা বড় ঠান্ডা জলের ট্যাংকের মধ্যে হাত ডুবিয়ে রাখার মতোন আনন্দ এখনো খান কতক তোলা আছে। সে গুলো করায় গন্ডায় অসুল না করে আমি যাচ্ছিনা। আমি পালায়িনী। আমি পালাচ্ছিনা। এখুনি না। 

- Shrestha Mukherjee, October, 2021 :)

1 comment: