‘দুর্গা পুজো’ শব্দ দুটির অনেক ধরনের মানে আছে। বিশেষ করে আমাদের মতন দু চার জন, যাদের ঈশ্বর, আদি-অনন্ত কনসেপ্টা বেশ ঘোলাটে লাগে, তাদের এই স্ট্যাগনেন্ট সময়ের বৃক্ষডালেও, উৎসব মুখর দিন গুলি তে এক রত্তি আকাশে কয়েক জোড়া ফানুস দেখতে এবং সন্ধে হলেই ক্যাপ বন্দুকের ঠাঁই- ঠাঁই শব্দ শুনতে মন্দ লাগেনা।
দুর্গা পুজোর আর আছে টা কি? প্রশ্নের উত্তরে এক অদ্ভুদ অভিমানের জায়গা থেকেই অনেক কে বলতে শুনেছি, উৎসব এবং উল্লাস, সবই এখন ভীষণ নিম্নগামী। এক্সট্রিমিসমের ঝরে, ঝড়া পাতার মতন পরে থাকে শরতের কিছু খুচরো সরলতা। পুজোর মেলায়, ফুচকা মেখে এগিয়ে দিতে গিয়েও, দাদা কে থতমত হয়ে আবার পিছিয়ে যেতে হয় কারণ ইনস্টা রিল টা ঠিক ভাবে নেওয়া হলোনা। ভাদ্র মাসের ঘোলাটে, লালচে হলুদ আকাশ দেখতে যাবে বলে কেউ গঙ্গার পারে পৌঁছে দেখে সেই ঘাট উপচে আছে মেরুন নীল শাড়ী তে। তবে তাতে দোষের কিছু নেই। আপনজনের উৎসব কে আপন করার ধরন ধারণ, ভিন্ন মানুষের ভিন্ন রকম।
তবে সবটাই এতটা অন্তঃসার শূন্য কেনো? আমি একান্ত ভাবে মনে করি, এর এক কারণ হলো ‘ভয়ে’। পিছিয়ে পড়ার ভয়ে, ভুলে যাওয়ার ভয়ে, এগিয়ে আসার ভয়ে, ছেড়ে দেওয়ার ভয়ে, পাশে থাকার ভয়ে, ভালো লাগার ভয়ে, ভালবাসার ভয়ে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং তাদের অনুচরেরা আমাদের ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ‘The way we are living is not enough’. ভেবে দেখুন যার স্টপ বাটন আমাদের হাতের মুঠোয়, তার ক্রিটিসিসমে আমরা নাকি কুপোকাত হচ্ছি। তার ফলে বেড়ে যাচ্ছে নিজেকে ক্রমশ আঘাত করার বাসনা।
তা যাক সে কথা। শরৎ আমি ভালবাসি। বাংলার মতন এমন humid রাজ্যে শরৎ কাল অনুভব করা, আর ইন্ডিয়া গেটের মাথায় aurora দেখা, দুটো একই ব্যাপার। কোনোটাই সম্ভব না। তাই এমন নেক্সট টু ইমপসিবল ডিজাইআর কিঞ্চিৎ অসংলগ মানুষিকতার পরিচয়ে দিয়ে ফেলে। শরৎ বলতে আমার দেশ অসময়ের বৃষ্টি আর পল্লা দিয়ে ঘাম ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। তবে ঘুম জড়ানো চোখে, রাতের শেষ প্রহরে যখন দূরে কোনো গাছের ডালে প্যাঁচার ডাক শোনা যায়, ভিজে বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলে, আমি আজও শুকনো ধুলো মাখা গাছের পাতা আর ধোঁয়াশা মাখা জ্যোৎস্নার গন্ধ পাই। আমার কাছে শরৎ বলতে এই টুকুই।
এই কংক্রিটের শহরে ভোর হলে, প্রথম ট্রাম আজও জানান দিয়ে এগিয়ে যায় যে সে এখনো আছে। আমাদের জীবনটাও ঠিক ওই লুপ্ত প্রায় ট্রামের মতন, দুমড়ে পড়ছে, তবুও তলিয়ে যাচ্ছেনা।
অফিসের টেবিলে যখন চারিধারে সবার কীবোর্ড খটখট শব্দ তুলে লিখে যায় আজ কাল ওহ পরশুর রোজনামচা, আমি চুপ থেকেই সেই উল্লাসে ভরা ব্যস্ত নিউসরুমে নিস্তব্ধতা খুঁজি। আজও, এখনো। চা চায়ের মতন পরে থাকে। সিগারেটের প্যাকেট গুলি ভীতু কাঠবেড়ালির মতন ড্রয়ারের মধ্যে থেকে বার কয়েক উকি মেরে আবার লুকিয়ে পরে। টেবিলের ওপর জমা হতে থাকে একটার পর একটা মিসড ডেডলাইনের চোখ রাঙানি।
সে ঘর ভর্তি অচেনা মানুষজনদের মাঝেও আমি শরৎ কাল কে আসতে দেখেছি। আশ্বিন মাসের মিঠে সুবাস ভাজ করা ডায়েরির মাঝে, কফি কাপে, এলিভেটরে, পুরোনো খবরের কাগজের স্তুপে আমি জন্ম নিতে দেখেছি।
আমার বন্ধু আজও পুরোনো কোনো ফেলা আশা শৈশবের এক দুঃস্বপ্নের কথা ভেবে কষ্ট পায়। আমি সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে পারিনি। তবে দু এক গোছা জুঁই ফুল রেখে এসেছি তার উঠোনে। এই বিশ্বাস নিয়ে আমি বাড়ি ফিরেছি, তাকেও আমারই মতন এই শরৎ আগলে নিজের মধ্যে রেখে দেবে। ভোর হয়ে এলে, যত্নে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
আমি আকাশকে মাঝে মাঝে বলি, বাড়ি ফেরার পথ তো অনেক আছে, তাহলে আমরা কেনো এই ঘুর পথে ফিরি? আকাশ তার উত্তরে সেই অন্ধকার গলি পথে আমার হাত ধরেছিল। সে পথে একটা বুড়ো শিউলি গাছ আছে। ভাগ্য ভালো থাকলে মহালয়ার ভরে আকাশ সেই গাছটার কাছ থেকে চেয়ে আনে কিছু ঝরে পড়া ফুল। যত্নে তাদের রাখে নিজের বুক পকেটে। সে আকাশকে আমি আমার স্বপ্নে দেখি রোজ। ঘুম ভেঙে গেলে, শুনতে পাই শিউলি গাছ কাটার শব্ধ।
তবুও শরৎ কে আমি শুনতে পাই। সে ফিসফিস করে আমায় আজও গল্প বলে মেঘের কোলে বাস করা সেই ছোটো রাজকুমারীর, যে জাদুর কাঠী ঘুরিয়ে ঝরিয়ে দিতে পারে গাছের সমস্ত পাতা, বুনে দিতে পারে অন্ধকূপের মাঝেও রূপকথা।
সেই রাজকুমারীকে আমি আজও দেখিনি, তবুও ভোর রাতে, ঘুম জড়ানো চোখে ধোঁয়াশার মধ্য শুনতে পাই তার ধেয়ে আশা, ছাতিম মাখা গন্ধ নিয়ে। বাড়িয়ে দেয় বন্ধুত্বের হাত।
শরৎ হয়ত আমার সেই রাজকন্যা।