99, Subinoye Ghosh Lane 🌼

99, Subinoy Ghosh Sarani.

কিছু দিন এমনও যায় যেদিন ছাদের ধারের ফুল গাছটায় জল পড়েনা, রোদ আসেনা, ছায়াও লাগেনা। দেওয়ালে শেওলা ধরছে ধীরে ধীরে। এ বাড়ি ভেঙে পড়ছে রোজ। তবুও উঠোনে রোজ গামছা মেলার তারে তারা দুজনে বাথরুম এর মগ নিয়ে খেলে নেয় এক রাউন্ড volleyball tournament। সেই রাউন্ড আজও Semi-Final টপকাতে পারেনি কিছু ব্যক্তিগত কারণে। গলির শেষ প্রান্তে এই থুরথুরে মেসবাড়ি আজও এক পা তুলে দাড়িয়ে আছে বাক্স-প্যাট্রা গুছিয়ে retirement phase এ যাবে বলে, কিন্তু এই বেয়াদপ মায়াজাল! Extension হয়ে ঘাড়ে বসে আছে।

শীতে পাটালি গুড়, গরমে ডাবের জল, শরতে বুড়ির চুল আছে বলেই আমাদের বন্ধুত্ব আজও আছে সেই ছাদের ফুল গাছটার পাশে পরে থাকা ভাঙা এন্টেনা কে ঘিরে। আমাদের মেস এর দোতলার উত্তর দিকের ঘরের জানলা থেকে ফাঁকা পুকুর পার দেখা যায় যেখানে আমাদেরই একজন রোজ বিকেলে হাতে এক গোছা চন্দ্রমল্লিকা আগলে রেখে বসে থাকে। ঘরের জানলার ধারে রাখা transistor এইদিক ঐদিক থেকে জড়ো করে আনছে ভাঙা গান আর না পাওয়া পড়ন্ত বিকেলের খেয়াল।

এদিকে সকালে উঠোনে রোজকার বাথরুম দখলের যুদ্ধ তো আছেই। তবে বিকেলে সেই উঠনেই ফিরে আসে গা এলিয়ে দেওয়ার ঘরে ফেরা। খুব ক্লান্ত শরীরেও লেগে থাকা ছেলেবেলার লেবু লজেন্সর এর স্বাদ দালানের কোণে পরে থাকা ভাঙা চেয়ার এর মতোই অবিচল। একই। এক ঘেয়ে। মায়া জড়ানো।

আমরা কারা থাকি এই মেসবাড়িতে, 

 কোথা থেকে আসি আমরা? কোথায় যাই? কেই বা আছে আমাদের পাশে, কাদের কথা ভেবে দুটো ঢোক ঠান্ডা জল বেশি খাই? কেউ জানিনা। কেউ কাউকে চিনিনা। তবুও, শেষ রাতে যখন ইচ্ছে করে অকারণে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে, তখন নিজের ঘর পেরিয়ে পাশের ঘরে টোকা মারতে হয়না। ছাদের দরজা খুলে আমাদেরই কেউ অপেক্ষা করে আমাদেরই কারুর। নরমে গরমে ফুলে ওঠা রসগোল্লার অভাব এদিকে কারুর হয়না। নালিশ নেই। তবে আক্ষেপ আছে। আরও কিছুদিনের। কিছু সন্ধ্যের।

দেওয়ালের চুন খসে পড়ছে বেশ কিছু মাস হলো। ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে আসছে তার রঙ। জানলার পাল্লা ভেঙে পড়ছে। সিলিং বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোটা ফোটা জল। মেরামতির নাম গন্ধ নেই কারণ এই আমাদের বেড়ে ওঠা নিজেকে ভেঙে দিয়ে। তবে করিবর্গার খাঁজে কবে যে আমাদের পাহাড়ি বৃষ্টির বাসা গড়ে উঠেছে, তা হয়তো দেওয়ালের ঘড়িতে মাপা যাবেনা। ভালো দিন, একটু উত্তরী হওয়া, উঠোনে বসে পিঠে রোদ লাগানো আর তালমিছড়ি খাওয়ার মতনই মিঠে। আরামকাতুড়ে।

এই সব কিছুই আছে আমাদের এক টুকরো মেসবাড়িতে। সেখানে থাকে হয়তো অনেকেই তবে আমরা কজন যেন জগজিৎ সিংহের গজল এর মতনই হলদেটে। কার সাথে কবে কার কখন দেখা হয়ে মনে থাকেনা। কতক্ষন কথা হয়ে খেয়াল থাকেনা। কার ভিজে চুপচুপে গামছা কার কাঠ ফাটা রোদে শুকিয়ে আশা শার্ট কে জড়িয়ে ধরে মনে পড়েনা, কার সিঁড়ির তলায় রাখা সাইকেল কার স্কুটারের ঘাড়ে উঠে পরে জানা যায়না। কিন্তু তাবলে কিছুই মিথ্যে হয়ে যায়না। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার যে এই নিশ্চিন্তের আনন্দ, সবটাই ভেসে যাচ্ছে আধখোলা দরজার ওপার থেকে ভেসে আসা মন্দ লাগার গল্পে। কিন্তু তাবলে এই মেসবাড়ির extension period কিন্তু এখানে থামছেনা। টিভি তে আরও দুটো চাপড় মেরে সেই দিনের মতন ইম্পরট্যান্ট ম্যাচটা দেখে নেওয়ার দিন যতদিন আছে, সেভাবে দুঃখের কথা জানতে না চেয়ে বই পাল্টে নিয়ে নতুন বই নেওয়ার ব্যস্ততা যতদিন আছে, ৫-৬ মাস অন্তর দেখা পাওয়ার দিন যতদিন আছে, শীতের রাতের ব্যাডমিন্টন যতদিন আছে, ততদিনের জন্যে ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সারাজীবনের মতন কাউকে যেতে দেওয়ার যে অসীম দুঃখ, তাকে জাস্ট তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। পুকুর পাড়ে সেই আগলে রাখা চন্দ্রমল্লিকা সেই আকাশের হোক, যেখানে রামধনু কালো মেঘের মতন গম্ভীর হয়ে, অংকের খাতায় লাল কালি দিয়ে ঘ্যেচঘুচ করে চালিয়ে যায়। এই সুবিনয় ঘোষ সরণির  মেসবাড়ির যে ঘুমকাতুড়ে বন্ধুত্ব, এই অনুভূতি যেন সবার হোক। 

হোক ! হোক! হোক!

শ্রেষ্ঠা 🌈